শান্তিপুরের বাহির চাঁদুনী কালীপুজো: ঐতিহ্যের ধারায় আজও জীবন্ত রীতি ও সংস্কার
মলয় দে নদীয়া:-
নদিয়ার শান্তিপুর শহরের প্রাচীনতম ও অন্যতম জাগ্রত কালীপুজো হলো বাহির চাঁদুনী কালীপুজো। প্রায় পাঁচ শতাব্দী আগে কাশীনাথ সার্বভৌমের হাত ধরে শুরু হয়েছিল এই পুজো, যা আজও সমান শ্রদ্ধা ও নিষ্ঠায় অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমে শুধুমাত্র একটিই মা চাঁদুনী ছিলেন। পরে মানুষের সুবিধার্থে ১৮৭৭ সালে পুজো কমিটির সঙ্গে মনোমালিন্যের জেরে ১৮৭৮ সালে শুরু হয় ভিতর চাঁদুনী কালীপুজো। সেই সময় থেকেই বাহির ও ভিতর চাঁদুনী—দুটি পুজোর রীতিনীতি প্রায় অভিন্নভাবে পালিত হয়ে আসছে, যা শান্তিপুরের ঐতিহ্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
বাহির চাঁদুনী পুজোর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বহু প্রাচীন সংস্কার ও পারিবারিক নিয়ম। কাশীনাথ সার্বভৌমের মা নিজ হাতে এই পুজোর বিধান লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই নিয়ম অনুযায়ী আজও বাড়ির শ্রেষ্ঠ গৃহবধূ প্রথমে মায়ের গায়ে মাটি লেপে পুজোর সূচনা করেন। তার পরেই মৃৎশিল্পীরা মূর্তি গড়ার কাজ শুরু করেন। পুজোর যাবতীয় আচার-বিচার, মন্ত্রোচ্চারণ ও ভোগ নিবেদন সম্পূর্ণভাবে বাড়ির পুরুষ সদস্যরাই সম্পন্ন করেন। ব্রাহ্মণরা কেবল সহায়তা করেন। তবে সবচেয়ে বিশেষ নিয়ম হলো—ভোগ রান্না ও ভোগের ঘরে প্রবেশের অনুমতি রয়েছে শুধু বাড়ির গৃহবধূদের। বিয়ের পরে যেহেতু বাড়ির মেয়েদের গোত্র পরিবর্তিত হয়, তাই তারা আর ভোগ রান্নায় অংশ নিতে পারেন না।
এই পুজোয় রয়েছে আরও এক বিশেষ ঐতিহ্য। বিজয়া দশমীর দিন মা চাঁদুনীর ‘পাঠ’ বা স্থানান্তর ঘটে বাহির থেকে ভিতরে—যা দুই চাঁদুনী মায়ের ঐক্যের প্রতীক। বাড়ির সদস্যরা জানান, ঠিক কোনটি প্রাচীন—মা চাঁদুনী না মা দুর্গা—তা নিশ্চিতভাবে কেউ বলতে পারেন না, কারণ বাড়িতে একটি প্রাচীন দুর্গা মন্দিরও রয়েছে।
সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ২০১৮ সালে এই ঐতিহ্যবাহী পুজো পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ডের সিদ্ধান্তে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিবার বা সদস্য পুজোর দায়িত্ব পান। এক প্রবীণ ভক্ত জানান, তিনি ১৯৮৯ ও ১৯৯১ সালে পুজো করেছিলেন, এরপর দীর্ঘ ৩৬ বছর পর ২০২৫ সালে আবারও মায়ের পুজো করার সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।
বাহির চাঁদুনী কালীপুজোর মূল আকর্ষণ শুধু আচার নয়, ভোগ ও প্রসাদও। বহু দূর থেকে ভক্তরা শুধুমাত্র মায়ের ভোগ প্রসাদ গ্রহণের জন্য এখানে আসেন। শতাব্দী প্রাচীন এই পুজো আজও শান্তিপুরবাসীর গর্ব—একটি জীবন্ত ইতিহাস, যেখানে বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও পারিবারিক বন্ধনের সমন্বয় ঘটেছে মা চাঁদুনীর আশীর্বাদে।


